‘দিবস দিয়ে কি করমু? কাজ না থাকলে তো আমাদের পেট চলে না। দিনের বেতন দিনেই হয়, আজ যা ইনকাম হবে তা দিয়েই সংসার চলে।’—এভাবেই নিজের জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরছিলেন দিনমজুর রফিকুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার (১ মে) আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে সরকারি ছুটি থাকলেও, ফেনীর বড় বাজার, তাকিয়া রোড বা ব্রিকস ফ্যাক্টরির মতো জায়গায় প্রতিদিনের মতোই ঘাম ঝরাচ্ছেন শত শত শ্রমিক।
অন্যান্য জেলার তুলনায় ফেনীতে কাজের সুযোগ বেশি হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে ভিড় করেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ভাসমান শ্রমিকরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন রংপুর, সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর ও কুমিল্লার মানুষ।
পাঁচবছর ধরে ফেনীতে কাজ করছেন শ্রমিক কাওসার মিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেটে খেতে হয়। রোদ-বৃষ্টি যা-ই হোক না কেন, থেমে থাকলে চলবে না। ট্রাক থেকে মালামাল ওঠানো-নামানো, বাজারের ব্যাগ গাড়িতে তুলে দেওয়া—সবই করি। দুর্ঘটনা ঘটলেও কেউ জিজ্ঞেস করে না, শুধু পেট চালাতে পারলেই হলো।’
তাকিয়া রোডের একটি মশলা কারখানায় কাজ করেন ৩৫ বছর বয়সী সেলিনা খাতুন। কাজের ঝাঁজ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মরিচ আর বিদ্যুৎ কাউকে রেহাই দেয় না। চোখে পানি আসে, গলা শুকিয়ে যায়। অনেক নারী এখানে কাজ করে, সবারই একই অবস্থা। কাজ না করলে কোনো আয় নেই। আজ কাজ করলে আজকের টাকা পাব।’
তাঁর সঙ্গে কাজ করা রুবিনা বেগম বলেন, ‘১২ ঘণ্টা টানা কাজ করি। মরিচ ভাঙার সময় চোখ-মুখ জ্বলে ওঠে, গলায় ধোঁয়া লাগে, তবুও চালিয়ে যাই। অসুস্থ হলেও ছুটি নেওয়া যায় না, ছুটি মানেই বেতন কাটা। সংসারের সব দায়িত্ব আমার কাঁধে।’
ফুলগাজীর বৈরাগপুরের একটি ইটভাটায় কাজ করেন জামাল হোসেন। শ্রমিক দিবস নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো দিন কাজে না এলে টাকা বন্ধ। দিবস তো কাগজে-কলমে, আমাদের জন্য কিছু না। পরিবার পেছনে তাকিয়ে আছে, তাই রোদে-পুড়ে, কষ্ট করে কাজ করে যাচ্ছি।’
ফেনী জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন খান বলেন, ‘ফেনীতে বহিরাগত শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। তাদের অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যুক্ত, কিন্তু চিকিৎসা ও নিরাপত্তা প্রায় অনুপস্থিত। অনেক শ্রমিক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছেন, কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন। এই শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।’
উল্লেখ্য, ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করেন। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ গুলি চালায়, প্রাণ হারান অনেকে। তাঁদের আত্মত্যাগের পর থেকেই ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য—‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’।